শিমুল মূল খাওয়ার ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা
শিমুল গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম:Bombax ceiba )আমাদের উপমহাদেশের একটি পরিচিত অমূল্যবান একটি ওষুধি উদ্ভিদ। যার লাল টকটকে ফুল শীতের শেষে বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। তবে এ গাছ শুধু চোখের আনন্দ নয় এর মূল লুকিয়ে আছে একাধিক ভেষজ গুণ যার শক্তিশালী ভেষজ উপাদান হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আয়ুর্বেদ ও ইউনিয়নে চিকিৎসা শাস্ত্রের শিমুল গাছের মূল বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে নানা রোগের চিকিৎসায়।নিচে আমরা শিমুল মূল খাওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরিতা তুলে ধরছি:
- শিমুল মূল খাওয়ার উপকারিতা
- যৌনশক্তি ও ধাতুশক্তিতে সহায়ক
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও বারবার প্রসবের সমস্যায় উপকারী
- শিমুল মূলের যৌন স্বাস্থ্য ভূমিকা
- পেট ও হজমের সমস্যার আশীর্বাদ
- ডায়রিয়া ও আমাশায়ে প্রাকৃতিক প্রতিশোধক
- কিডনি ও প্রসাবের সমস্যায় উপকারী
- ত্বক সুস্থ ও রক্তের বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- ব্যবহার ও গ্রহণ পদ্ধতি
- সতর্কতা ও পরামর্শ
- শেষ কথা
১. শিমূল মূল খাওয়ার উপকারিতাঃ
২.যৌন শক্তি ও ধাতু শক্তিতে সহায়ক:
শিমুল মূল বহুদিন ধরে প্রাকৃতিক অ্যাফ্রোডিজিয়াক বা যৌনশক্তি বৃদ্ধি কারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি শুক্রানুর পরিমাণ বৃদ্ধি করে,ধাতুর দুর্বলতা কমায় এবং পুরুষের যৌন স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। শিমুলপুর প্রাকৃতিকভাবে যৌন দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করে এটি শুক্রানু পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি করে ফলে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অনেক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা এটি যৌন উত্তেজক বা অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যাদের ধাতু পাতলা হয়ে যায় বা এরকম ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তাদের শিমুলের মূল অত্যন্ত উপকারী ভেষজ হতে পারে।
আরো পড়ুন:পেট ফাঁপা ও তার প্রতিকার
৩.প্রসবের জ্বালা-পোড়া ও বারবার প্রসাবের সমস্যা ঃ
আপনারা অনেকেই
প্রসাবের জ্বালা-পোড়া বা ঘন ঘন প্রস্রাব সমস্যায় ভোগেন এ ধরনের সমস্যার
শিমূল মূলের গুড়া বিশেষ উপকার হয়ে থাকে । যাদের ইউরোনারি ট্রাস্ট ইনফেকশন
বা মূত্রথলিতে ইনফেকশন বা কিডনির সম্পর্কিত সমস্যায় ভালো কাজ করে। তাদের শিমুল
মূল এর গুড়ায় বিশেষ উপকার হয়ে থাকে ,এটি প্রস্রাব পরিষ্কার করে প্রসবের সংক্রমণ
ও কিডনির কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৪.শিমুল মূলের যৌন স্বাস্থ্য ভূমিকা:
যাদের ধাতু দুর্বলতা, দ্রুত বীর্যপাত বা
কামশক্তি হ্রাস পেয়েছে ,তাদের জন্য এটি একটি উত্তম সমাধান।শিমূল মূল শুক্রাণুর
পরিমাণ ও গতিশীলতা বাড়ায়, ফলে প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এটি দেহের
অতিরিক্ত তাপ কমায়েএবং আমাদের শরীরের হরমোন এর সমতা রক্ষা করতে সহায়তা করে।
আয়ুর্বেদে এঁকে ‘বীর্যবর্ধক ’ভেষজ বলা হয়, যা পুরুষের যৌনশক্তি ও সহনশীলতা
বাড়াতে সাহায্য করে। যেহেতু এটা একটু সম্পূর্ণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তুলনামূলক
কম যদি আপনি নিয়মিত নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করেন তাহলে এটি আপনার যৌন
স্বাস্থ্য ও যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আত্মবিশ্বাস ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
৫.পেট ও হজমের সমস্যায় আশীর্বাদঃ
শিমুল মূল হজম
শক্তি উন্নত করে এবং পেটের নানা ধরনের সমস্যা (পেট ফাঁপা, গ্যাস্ট্রিক ,অম্লতা
,আলসার ইত্যাদি রোগের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। গ্যাস অম্বল,
গ্যাস্ট্রিক, বুক জ্বালা-পোড়া কিংবা বদহজম এটি বিশেষ উপকারী। শিমুল
মূলের আন্টি- ইনফ্লেমেটরি উপাদান-অন্ত্রের প্রদাহ কমায়, হজম প্রক্রিয়া
স্বাভাবিক রাখে এবং আলসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। অনেক আয়ুর্বেদিক ঔষধের শিমুল
মূলকে পেটের শান্তির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত
মসলাযুক্ত খাবার খান বা খাদ্যাবাস অনিয়মিত তাদের জন্য শিমুল মূল হতে পারে একটি
প্রাকৃতিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিহীন সমাধান।
আরো পড়ুন: আমাশায়ের বিভিন্ন লক্ষণ ও কারণ
৬.ডায়রিয়া ও আমাশায়ের প্রাকৃতিক প্রতিষেধকঃ
শিমুল মূল
পাতলা পায়খানা, ডায়রিয়া ,পাকস্থলীর দুর্বলতা ও আমাশার মতো রোগের উপশম দেয়।
এটি অন্ত্রকে শক্তিশালী করে ও পাকস্থলি সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা
প্রাকৃতিক ট্যানিন ও এন্টি-মাইক্রোরিয়াল উপাদান অন্ত্রে জীবাণুর বৃদ্ধি রোধ করে
এবং অতিরক্ত পানি নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। শিমুল মূলের গুড়া একমাস কুসুম গরম
পানিতে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে পাকস্থলীর ভারসাম্য রক্ষা হয়। এটি অন্ত্রকে
শক্তিশালী করে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া র্নিমূল করে। গ্রামীন স্বাস্থ্য চর্চায় এখনো
অনেক শিশুদের আমাশয়ের চিকিৎসায় শিমুল মূলের ব্যবহার করে থাকেন। এটা কোন পার্শ্ব
প্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগ প্রতিরোধে কাজ করে।
৭.কিডনি ও প্রসাবের সমস্যায় উপকারীঃ
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া প্রসাবে জ্বালাপোড়া বা সংক্রমনের মত সমস্যায় শিমুল মূল
অত্যন্ত কার্যকরী।এটি কিডনী পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে ও ইউরিনারি ট্রাস্ট
ইনফেকশন প্রতিরোধ সহায়ক। শরীরের অতিরক্ত পানি ও লবণ দূর করে এটি
প্রাকৃতিক ডাই ইউরোটিক হিসেবে কাজ করে। যারা প্রসবের সমস্যায় ভোগেন বা
কিডনির কার্যকারিতা দুর্বল তারা চিকিৎসকের পরামর্শের শিমুল মূল খেতে পারেন।
নিয়মিত ব্যবহারে প্রসব স্বাভাবিক হয় এবং বাথরুমে বারবার যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা
হ্রাস পায়।
৮.ত্বক সুস্থ ও রক্ত বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করেঃ
শরীরের ভিতরে রক্ত যদি বিশুদ্ধ না হয় তাহলে
সেটার প্রভাব পড়ে ত্বকের উপর এজন্য ত্বকে বিভিন্ন ধরনের রাস, ব্রণ,
চুলকানি অন্যান্য চর্মরোগ দেখা দেয়। শিমুল মূল প্রাকৃতিক ভাবে রক্ত
বিশুদ্ধকার হিসেবে কাজ করে এটি লিভার পরিষ্কার করে এবং শরীর থেকে টক্সিন দূর করে
দেয়। এর ফলে ত্বক উজ্জ্বল হয়, পরিষ্কার, ব্রণ মুক্ত হয়। যাদের অতিরিক্ত ঘাম
হয় বা চুলকানিতে ভোগেন তারা শিমুল মুলের গুড়ো খেলে উপকার পেতে পারেন পাশাপাশি
এটি মুখের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
৯.রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ
শিমুল মূল রয়েছে নানা প্রাকৃতিক
এন্টি-অক্সিডেন্ট ও এন্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা শরীরের স্নায়ু সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এটি নিয়মিত
গ্রহণ করলে শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক সংক্রমণ থেকে আপনার
শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও অবসাদে উপকারঃ
দীর্ঘদিনের ক্লান্ত দুর্বলতা ঘুমের অভাব কিংবা স্নায়ুর দুর্বলতায় ভোগা রোগীদের জন্য শিমুল মূল সহায়ক হতে পারে এটি দেহের শক্তি যোগায় মানসিক চাপ কমায় এবং শান্ত রাখতে সাহায্য করে।
ইমিউন সিস্টেমের শক্তি যোগায়ঃ
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী না হলে বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শিমুল মূলে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ,এন্টি-ইনফ্লেমেটরি ও এন্টি-মাইক্রো বিয়াল উপাদান, যা শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের জন্য শিমুল মূল একটি কার্যকর। পানিতে ভিজিয়ে নিয়মিত সেবন করলে এটি বার্ধক্য জনিত দুর্বলতা ও কমায়।
স্নায়ুবিক দুর্বলতা ও ক্লান্তিতে কার্যকরঃ
শিমুল মূল
শরীরের স্নায়ুগুলোকে শান্ত রাখে ও শক্তিশালী করে তোলে। যারা দীর্ঘদিন ক্লান্তি,
অবসাদ, মানসিক চাপ বা শরীরে দুর্বলতা , স্নায়ু দুর্বলতা বা অবসাদজনিত সমস্যায়
ভুগছেন তারা শিমুল মূল নির্যাস খেলে ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে আসে এবং মানসিক
প্রশান্তি দূর হয় ,ঘুম ভালো হতে সাহায্য করে এবং শরীরকে সতেজ রাখে। বিশেষ করে
যারা অফিসের চাপ বা মানসিক দুশ্চিন্তাই থাকেন তাদের জন্য এটি হতে পারে একটি
প্রাকৃতিক ভেষজ।
১০.সঠিক ব্যবহার ও গ্রহণ পদ্ধতিঃ( কিভাবে ভাবে খাবেন)
শিমুল মূল সাধারণত শুকিয়ে গুড়ো করে গ্রহণ করা হয়। প্রতিদিন এক চা চামচ গুঁড়ো কুসুম গরম পানির সাথে খাওয়া যায় অথবা মধু সঙ্গে মিশিয়ে। অনেককে একটি আয়ুর্বেদিক ফর্মুলায় দুধের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকেন। খালি পেটে খাওয়া বেশি উপকারী। তবে নিয়মিত ব্যবহারের আগে একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই ভালো। কারণ শরীরের অনুযায়ী মাত্রা ও উপযোগিতা ভিন্ন হতে পারে।
আরো পড়ুন:হজম শক্তিতে পাথর কুচি পাতার কার্যকারিতা
উপকরণ: শুকনো শিমুল মূলের গুড়া এক চা চামচ, দুধ, মধু বা কুসুম গরম পানি।
ব্যবহার: সকালে খালি পেটে অথবা রাতে সোবার আগে খাওয়া ভালো।
ব্যবধান: সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন খাওয়া যেতে পারে।
সতর্কতা ও পরামর্শঃ(যাদের খাওয়া যাবেনা না)
যদিও শিমুল মূল স্বাভাবিক নিরাপদ তারপরও কিছু সতর্কতা মেনে চলা উচিত।
- গর্ভবতী ও স্তন্যদান কারী মায়েদের এটি খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
- মাত্রা অতিরিক্ত সেবন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
- শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাই ভালো।
- নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন নিচ্ছে এমন ব্যক্তির ব্যবহার শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
- অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন মাত্রা অতিক্রম করলে পেট খারাপ বা দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
- যেহেতু এটি একটি ভেষজ ওষুধ, তাই মাত্রা ও প্রয়োগবৃদ্ধি ব্যক্তি ভেদে বিভিন্ন হতে পারে।
- উপসর্গ অনুযায়ী এর মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে।
শেষ কথাঃ
শিমুল মূল প্রাকৃতিক চিকিৎসায় একটি অদার্থ উপাদান। এর বহুমুখী উপকারিতা আমাদের
শরীর ও স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যে কোন প্রকার
রাসায়নিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে এই ভেষজ উপাদানটি আমাদের প্রাচীন চিকিৎসার
পদ্ধতিতে অমূল্য রত্ন। প্রাকৃতিক ওষুধের ভান্ডারে শিমুল মূল দুর্লভ সম্পদ্ এটি
যেমন শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করে তেমনি নানা জটিল সমস্যা ত্বকের রোগ ইত্যাদিতে
দারুন কার্যকর। নিয়মিত সঠিক মাত্রায় শিমুল মূল গ্রহণ করলে শরীর মন ভালো থাকে।
তবে সব ভেষজের মতোই শিমুল মূলক সচেতন ভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করায়
বুদ্ধিমানের কাজ।
রায়আন আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url