ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকার


ভূমিকাঃ
মানুষের জীবনে ঘুম একটি বড় ঔষধ। ঘুম পরিতৃপ্ত হলে মানসিক অবস্থা ,শারীরিক অবস্থা ও পাপার্শ্বিক অবরিস্থা সবই তার কাছে ভালো লাগে। ঘুম যদি কম হয় বা ঘুমের অপরিতৃপ্তিতা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । তাই পর্যাপ্ত ঘুম  ‍সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য ।



ঘুম না  আসা বা অপর্যাপ্ত ঘুম শুধু আপনাকে ক্লান্ত বা খিটখিটে করে না, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শরীরের প্রতিটি তন্ত্রের ওপর ঘুমের গভীর প্রভাব রয়েছে। ঘুম না আসার কারণে নানা ধরণের রোগ   আপনার শরীরে বাসা বাধতে পারে।

ঘুম না আসার কারণ ও প্রতিকারঃ

আপনার কি ঘুম আসেনা ঘুম না আসা বা অনিদ্রা একটা সাধারন সমস্যা, যার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এখানে প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো।
  • মানসিক চাপ ও উদ্বেগঃ আপনার দৈনন্দিন জীবনের মানসিক চাপ, উদ্যোগ, দুশ্চিন্তা বা কোন মানসিক আঘাত ঘুমের ওপর ঘুমের নেতিবাচক প্রভাব আনতে পারে।
  • জীবনযাত্রার ভুল অভ্যাসঃ
    • অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচীঃ আপনি প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে না যাওয়া এবং ঘুম থেকে সময় মত না ওঠা অনিদ্রার বড় কারণ হতে পারে।
    • ক্যাফেইন ও নিকোটিনঃ আপনি যদি ঘুমানোর আগে ক্যাফ্নেইন ( চা ,কফি বা অন্যান্য ক্যাফেইন যুক্ত পানীয় )এবং ধূমপান বা জর্দ্দা  সেবন করেন তাহলেও ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
    • অ্যালকোহলঃ অ্যারহকোহল যদিও ঘুম আসতে সাহায্য করে। তবে  এটি ঘুমের গুণগত মান নষ্ট করে এবং  মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে দিতে পারে যা আপনার জন্য কষ্ট কর হবে।
    • অতিরিক্ত  স্ক্রিন টাইমঃ আপনি যদি ঘুমানোর আগে মোবাইল ফোন ,ট্যাবলেট ,কম্পিউটার বা টেলিভিশন দেখে থাকেন। তবে তবে এসব ইলেকট্রিক ডিভাইস থেকে যে নীল আলো নির্গত হয় তা আমাদের মস্তিষ্ক থেকে মেলামাইন নামক হরমোন নিসৃত হতে বাধা প্রদান করে যা ঘুমের জন্য অতি জরুরী।
    • অপর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপঃআপনি যদি দিনের বেলায় পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম না করেন তাহলে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হতে পারে ।
  • চিকিৎসা জনিত কারণঃ
    • ব্যাথ্যঃ আপনার যদি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা থাকে যেমন -(মাথা ব্যথা ,পিঠের ব্যথা ,হাঁটুর ব্যথা ,কেমরের ব্যাথা বা  জয়েন্টে ব্যাথা) হতে পারে যা আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
    • শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যাঃ আপনি যদি স্লিপ অ্যাপনিয়া ঘুমের সময় (শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া )হাঁপানি বা এলার্জি এ ধরনের রোগে ভোগেন তাহলেও আপনার ঘুমের সমস্যা করতে পারে।
    • হজমের সমস্যঃ গ্যাস্ট্রিক ,এসিডি টি, রিফ্লাক্স বা বুক জ্বালাপোড়া রাতে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। তাহলে আপনার ঘুমের সমস্যা করতে পারে। 
    • হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ থাইরয়েড সমস্যা বা মেনোপোজের সময় হরমোনর পরিবর্তন ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ হতে পারে।
    • মানসিক রোগঃ বিষন্রতা, বাইপোলার ,ডিসর্অডার বা উদ্বেগজনিত সমস্যা অনিদ্রার কারণ হতে পারে।
    • কিছু ঔষোধ সেবনঃ আপনি যদি এমন কিছু ঔষোধ সেবন করেন যে সকল ঔষোধ এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনিন্দ্রা দেখা দিতে পারে যেমন কিছু অ্যান্টিবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ বা স্তরের জন্য
  • পরিবেশগত কারণঃ
    • শোবার ঘরের পরিবেশঃ আপনি যে ঘরে ঘুমান সেই ঘরে অতিরিক্ত আলো, শব্দ, গরম বা ঠান্ডা ঘর ঘুমানোর জন্য অনুকূল নাও হতে পারে।
    • অস্বস্তিকর বিছানাঃঅস্বস্তিকর বিছানা বা আরামদায়ক বিছানা না হলে ঘুম আসতে সমস্যা হতে পারে।
  • বাধ্যক্য জনিত কারণঃ বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঘুমের ধরণ পরিবর্তিত হয় এবং অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় বা ঘুমের পরিমাণ কমে যায়।
আরো পড়ুনঃরাতে ভালো ঘুমানোর জন্য যে সকল বদঅভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

ঘুম কম হলে কি কি রোগ হয়ঃ

        ঘুম না  আসা বা পর্যাপ্ত ঘুম শুধু আপনাকে ক্লান্ত বা খিটখিটে করে না বরং এটি দীর্ঘমেয়াদী একটি গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায় শরীরের প্রতিটি তন্ত্রের উপর ঘুমিয়ে প্রভাব রয়েছে। কম ঘুম হলে যেসব রোগ আপনার শরীরে বাসা বাধতে পারে।
  • হৃদরোগ ও স্টোকঃ আপনার পর্যাপ্ত ঘুম না হলে রক্তচাপ বেড়ে যায়, যা হৃদরোগ ও স্টোক এর অন্যতম প্রধান কারণ। ঘুমের অভাবে হাটের উপর চাপ পড়ে এবং  উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। রক্তনালিতে চর্বি জমে এবং হৃদ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
  • ডায়াবেটিসঃ  আপনার ঘুম কম হলে শরীরে কার্যকারিতা কমে যায় যা রক্তের  ইনসুলেনের পরিাণ বাড়িয়ে দেয় এর ফলে টাইপ -২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক অংশে বেড়ে যায়।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাঃ পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বিষ্ণুতা  উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায় ।মন-মেজাজ খারাপ থাকা, বিরক্তিকর ভাব, অল্পতে রেগে যাওয়া, ভালো কথা খারাপ লাগা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এ ধরনের মানসিক রোগ হতে পারে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে কমে যাওয়াঃ পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর ফলে সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে বড় ধরনের সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে।
  • স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞানীয় ও দুর্বলতাঃ ঘুম না আসার কারণে মস্তিষ্কে সারা দিনের জন্য তথ্য প্রক্রিয়া করে এবং স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে ।কম ঘুম না হলে স্মৃতিশক্তি হাস হয় এবং মনোযোগ কমে যায় ।শেখার ক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এতে কর্মক্ষেত্র বা পড়াশোনায় খারাপ প্রভাব পড়ে।
  • উচ্চ রক্তচাপঃ দীর্ঘস্থায়ী ঘুম না আসা বা অনিদ্রতায় ভুগলে উচ্চ রক্তচাপ এর  একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে এর ফলে হরমোন গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ঘুম না আসার প্রভাবে এই হরমোন গুলো ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় যা উচ্চ রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
  • দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধিঃ ঘুম না  আসার প্রভাবে সতর্কতা প্রতিক্রিয়ার সময় এবং বিচার করার ক্ষমতা কমে যায় এর ফলে গাড়ি চালানো বা যন্ত্রপাতি পরিচালনার সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক অংশ বেড়ে যায়।
  • ত্বকের সমস্যাঃ আপনার পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ঘুমের অভাবে ত্বকের উপর প্রভাব পড়ে ঘুমের সময় ত্বক নিজেকে মেরামত  ও পুনঃজীবিত করে ।পর্যাপ্ত ঘুম না হলে কোলাজেন উৎপন্ন কমে যায়। যার ফলে ত্বকের অকাল বার্ধক্য দেখা দেয় ,এমন কি চোখের নিচে কালো দাগ দেখা দেয়।
  • হজমের সমস্যাঃ ঘুম না আসায় অর্থাৎ ঘুমের অভাবে আমাদের খাদ্য হজমের জন্য পাকস্থলী থেকে যে এনজাইম নিসৃত হয় তা সুষ্ঠভাবে হতে পারে না ফলে পেটের নানা  রোগ দেখা দেয় যেমন- গ্যাস্ট্রিক ,আলসার সহ অন্যান্য রোগ দেখা দিতে পারে।


ঘুম না  আসা রোগের নামঃ

ঘুম না আসা রোগের নাম হল অনিদ্রা।এটি একটি সাধারণ ঘুমের ব্যাধি যেখানে একজন ব্যক্তি ঘুমিয়ে পড়তে  বা ঘুমিয়ে থাকতে  উভয়ই কঠিন হয় ।যার ফলে দিনের বেলা ক্লান্তি এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয় অনিদ্রিতা আবার বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে
তীব্র অনিদ্রা ঃ
এটি অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয় সাধারণত কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ এটি প্রায়ইশ চাপ বা অসুস্থতা বা অন্য কোন পরিবর্তন এর কারণে হতে পারে।
দীর্ঘ স্থায়ী অনিদ্রাঃ দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রতা এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে সাধারণত তিন মাস বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে। সপ্তাহে অন্তত তিন রাত ঘুম না আসলে একে দীর্ঘস্থায়ী অনিন্দ্রা বলে ।সহযোগী রোগ আছে যা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে যেমন ঘুমের সময় বার বার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া , ঘুমের সময় পায়ে অস্থির অনুভূতি বা পা নড়াচড়া তীব্রই ইচ্ছা করা  রোগের মধ্যে পড়ে।

ঘুম না আসলে করণীয় কিঃ

ঘুম না আসা খুবই হতাশা জনক হতে পারে কিন্তু কিছু কার্যকর কৌশলাপান মনে করলেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এখানে কিছু করণীয় আলোচনা করা হলো 
১. ঘুমের একটি নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করুনঃ
নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ওঠাঃ প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং ঘুম থেকে উঠুন এমনকি ছুটির দিনেও এটি আপনার অভ্যাস গড়ে তুলুন নির্দিষ্ট রুটিন মাফিক চললে  আপনাকে অনিন্দ্রা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে।
দিনের বেলায় ঘুম ঘুম এড়িয়ে চলুনঃ যদি দিনের বেলায় ঘুমাতে হয় তাহলে ২০ থেকে ৩০ মিনিটের বেশি যেন না হয় এবং দুপুরের প্রথম ভাগের মধ্যে সেরে ফেলুন।
২. সবার ঘরের পরিবেশ আরামদায়ক রাখুনঃ
  • ঘুমানোর পূর্বে ঘর অন্ধকার ও নীরবতা পরিবেশ সৃষ্টি করুন
  • আরন্দায়ক বিছানা হওয়া উচিত
  • এসি বা তাপমাত্রা সহনীয় রাখুন
৩. ঘুমানোর আগে কিছু বিষয় এড়িয়ে চলুনঃ
  • ঘুমানোর স্বাদ থেকে আট ঘন্টা পূর্বে ক্যাফেইনও নিকোটিন পান করবেন।
  • অ্যালকোহল সেবন পরিহার করুন।
  •  ঘুমানোর এক থেকে দেড় ঘন্টা আগে ভারি  খাবার গ্রহণ করুন।
  • ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস যেমন- মোবাইল ,কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদি ১ ঘন্টা পূর্বে দেখা শেষ করবেন।
৪. দিনের বেলার অভ্যাস পরিবর্তন করুনঃ
  • নিয়মিত  ব্যায়াম করুন দিনের বেলায়।
  • মানসিক চাপ কমানো  ও নিজেকে ফ্রি রাখুন।
৫. ঘুমানোর আগে রিলাক্স করুনঃ
  • গরম পানিতে গোসল করবেন ঘুমের আগে।
  • বিছানায় শুয়ে বই পড়া অভ্যাস করে তুলুন।
  • বিছানায় যাওয়ার সময় গান শোনো বা কোরআন তেলওয়াত শুনুন।
  • আরামদায়ক কার্যকলাপ  হওয়া উচিত।

আপনার চোখে ঘুম কিন্তু ঘুম আসেনাঃ

        চোখে ঘুম কিন্তু ঘুম আসে না" - এই অনুভূতিটা খুবই পরিচিত এবং হতাশাজনক। এর মানে হলো, আপনার শরীর এবং মন ঘুমের জন্য প্রস্তুত কিন্তু কোনো কারণে ঘুমিয়ে পড়তে পারছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে, এবং সেগুলোর সমাধান জানলে আপনি ভালো ঘুম পেতে পারেন।

চোখে ঘুম কিন্তু ঘুম না আসার কারণ
  • মানসিক উত্তেজনাঃ এটি সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটি। আপনি ক্লান্ত হলেও আপনার মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সক্রিয় থাকে।
  • দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগঃ দিনের বেলার চিন্তা, আগামী দিনের কাজ, কোনো সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা - এসব আপনার মনকে শান্ত হতে দেয় না।
  • অতিরিক্ত চিন্তাঃ ঘুমানোর আগে যদি অনেক বেশি ভাবেন বা কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত বিশ্লেষণ করেন, তাহলে ঘুম আসে না।
  • উত্তেজক কার্যকলাপঃঘুমানোর আগে টিভি দেখা, ভিডিও গেম খেলা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা বা কোনো তীব্র বিতর্কে জড়ানো মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে তোলে।
  • অনিয়মিত ঘুমের রুটিনঃ প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে না যাওয়া এবং ঘুম থেকে না ওঠা আপনার শরীরের স্বাভাবিক ঘুম-জাগরণ চক্রকে (সার্কাডিয়ান রিদম) ব্যাহত করে। এতে শরীর বিভ্রান্ত হয়ে যায়, ফলে যখন ঘুমানোর কথা, তখনও ঘুম আসে না।
  • নীল আলোর প্রভাবঃ মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার বা টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদনে বাধা দেয়। মেলাটোনিন হলো ঘুমের জন্য অপরিহার্য হরমোন। ঘুমানোর আগে এই ডিভাইসগুলো ব্যবহার করলে মস্তিষ্ককে ঘুমানোর সংকেত দিতে অসুবিধা হয়।
  • শারীরিক অস্বস্তি বা ব্যথাঃ শরীরে ব্যথা, বুক জ্বালাপোড়া, পা ব্যথা (যেমন রেস্টলেস লেগস সিন্ড্রোম) অথবা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা থাকলে শরীর ক্লান্ত হলেও ব্যথা বা অস্বস্তির কারণে ঘুম আসতে পারে না।
  • ঘুমের পরিবেশঃ শোবার ঘর যদি বেশি গরম বা ঠান্ডা হয়, কোলাহলপূর্ণ হয়, বা অতিরিক্ত আলো থাকে, তাহলে শরীর ঘুমাতে চাইলেও পরিবেশগত কারণে ঘুম আসতে পারে না।
  • কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃকিছু নির্দিষ্ট ঔষধ, যেমন - কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, রক্তচাপের ঔষধ, বা হাঁপানির ঔষধ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
   আরো পড়ুনঃরাতে ঘুম ভালো হওয়ার উপায়

কোন কোন ভিটামিনের অভাবে ঘুম আসেনা বা ঘুম কম হয়ঃ

    ঘুম কম হওয়ার বা ঘুম না আসার পেছনে বেশ কিছু ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব দায়ী হতে পারে। নিচে প্রধান কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
  • ভিটামিন ডিঃ এটি ঘুমের সাথে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত ভিটামিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডি-এর অভাব অনিদ্রা, কম ঘুম এবং রাতে ঘন ঘন ঘুম ভাঙার ঝুঁকির সাথে জড়িত। ভিটামিন ডি মস্তিষ্কের কিছু অংশে ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা রাখে এবং মেলাটোনিন হরমোনের (যা ঘুমচক্র নিয়ন্ত্রণ করে) উৎপাদনে সহায়তা করে।
  • ভিটামিন বি-৬ পাইরিডক্সিনঃ এই ভিটামিনটি মেলাটোনিন এবং সেরোটোনিন হরমোন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেরোটোনিন হলো একটি নিউরোট্রান্সমিটার যা মেজাজ এবং ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, এবং মেলাটোনিন সরাসরি ঘুমচক্রকে প্রভাবিত করে। ভিটামিন বি৬ এর অভাব অনিদ্রা এবং বিষণ্ণতার লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। 
  • ভিটামিন বি১২ঃ ভিটামিন বি১২ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং স্নায়ুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এটি মেলাটোনিন উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন বি১২ এর অভাব ঘুমের ব্যাঘাত এবং দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম আসার কারণ হতে পারে। তবে কিছু গবেষণায় এর বিপরীত ফলও দেখা গেছে। 
  •  ভিটামিন সিঃ  যদিও ভিটামিন সি মূলত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য পরিচিত, এটি ঘুমের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু গবেষণায় ভিটামিন সি এর অভাবকে কম ঘুমের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। 
  • ম্যাগনেসিয়ামঃ এটি যদিও ভিটামিন নয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ, যা ভালো ঘুমের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ম্যাগনেসিয়াম পেশী শিথিল করতে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এর অভাবে অনিদ্রা, পেশী ক্র্যাম্প এবং অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
  • ভিটামিন ইঃএটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা কোষের স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ই সম্পূরক গ্রহণ করলে অনিদ্রা কমে এবং ঘুমের মান উন্নত হয়। 

১ মিনিটে ঘুমানোর উপায়ঃ
    ১ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা শুনতে একটু অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, তবে কিছু কৌশল আছে যা আপনার মন এবং শরীরকে দ্রুত শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করতে পারে। সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কার্যকর পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি হলো "৪-৭-৮ শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল" । এটি ড. অ্যান্ড্রু ওয়েইল উদ্ভাবন করেছেন এবং এটি মনকে শান্ত করতে, উদ্বেগ কমাতে এবং দ্রুত ঘুম আনতে অত্যন্ত কার্যকর।

  • ১ মিনিটে ঘুমানোর কৌশল: "৪-৭-৮" শ্বাস-প্রশ্বাস পদ্ধতি
এই কৌশলটি অনুশীলনের জন্য একটি আরামদায়ক অবস্থানে বসুন বা বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আপনার জিহ্বার ডগা ওপরের পাটির দাঁতের গোড়ায় (সামনের দুটি দাঁতের ঠিক পেছনে) রাখুন এবং পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে সেখানেই ধরে রাখুন।
পদ্ধতিটি ধাপে ধাপে অনুসরণ করুন:
  • ৪ সেকেন্ড (শ্বাস নিন): আপনার মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন। মনে মনে ১, ২, ৩, ৪ গুনুন।
  •  ৭ সেকেন্ড (শ্বাস ধরে রাখুন): আপনার শ্বাস ৭ সেকেন্ড ধরে রাখুন। এ সময় আপনার দম আটকে রাখুন এবং কোনো বাতাস ভেতরে বা বাইরে যেতে দেবেন না। মনে মনে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ গুনুন।
  • ৮ সেকেন্ড (শ্বাস ছাড়ুন): এবার আপনার মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে ধীরে ধীরে ৮ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস ছাড়ার সময় হালকা হিস হিস বা ফুঁ দেওয়ার মতো শব্দ করুন। মনে মনে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ গুনুন।
  • পুনরাবৃত্তি: এই চক্রটি মোট ৩ বার পুনরাবৃত্তি করুন।অর্থাৎ, শ্বাস নিন (৪ সেকেন্ড) -> শ্বাস ধরে রাখুন (৭ সেকেন্ড) -> শ্বাস ছাড়ুন (৮ সেকেন্ড)। এই প্রক্রিয়াটি ৩ বার করার পর আপনি একটি পূর্ণাঙ্গ চক্র সম্পন্ন করবেন।
কেন এটি কাজ করে 

  • প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তাঃ এই শ্বাস-প্রশ্বাস কৌশলটি আপনার শরীরের প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে, যা শরীরকে শিথিল করতে এবং শান্ত করতে সাহায্য করে। এটি হৃদস্পন্দন কমায় এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক করে।
  • মনোযোগের স্থানান্তরঃ যখন আপনি শ্বাস গোনার দিকে মনোযোগ দেন, তখন আপনার মন দিনের চিন্তা বা উদ্বেগ থেকে সরে আসে। এটি মনকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত করে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।
  • অক্সিজেন সরবরাহঃ এই পদ্ধতিতে শ্বাস ধরে রাখার কারণে ফুসফুসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে, যা শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত করে এবং একটি শিথিল অনুভূতি তৈরি করে।

রাতে ঘুমানোর দোয়াঃ

রাতে ভালো ঘুমের জন্য বেশ কিছু দোয়া ও আমল রয়েছে, যা আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়ে গেছেন। এসব দোয়া আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা এবং তাঁর স্মরণের মাধ্যমে অন্তরকে প্রশান্ত করতে সাহায্য করে।


  • আয়াতুল কুরসি পাঠ করাঃঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসি (সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত) পাঠ করা খুব ফজিলতপূর্ণ। এর মাধ্যমে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং ঘুমে প্রশান্তি আসে।
আরবি

اللّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَاء وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَلاَ يَؤُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ

উচ্চারণ:
"আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যূমু লা তা’খুযুহু সিনাতুন ওয়ালা নাউম। লাহূ মা-ফিস সামা-ওয়া-তি ওয়ামা-ফিল আরদি। মান যাল্লাযী ইয়াশফা‘উ ‘ইনদাহূ ইল্লা বিইযনিহী। ইয়া‘লামু মা-বাইনা আইদীহিম ওয়ামা-খালফাহুম। ওয়ালা ইউহীতূনা বিশাইয়িম মিন ‘ইলমিহী ইল্লা বিমা-শা-আ। ওয়াসি‘আ কুরসিয়্যুহুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা। ওয়ালা ইয়াউদুহূ হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলিয়্যুল ‘আযীম।"
সরল অর্থ:
"আল্লাহ্; তিনি ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সব তাঁরই। কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে, তা তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টন করতে পারে না, তবে তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন। তাঁর কুরসী আসমান ও যমীনকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। আর এ দু’টিকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেও কষ্টসাধ্য নয়। তিনিই সুউচ্চ, সুমহান।"


 আরো পড়ুনঃ ঘুমানোর জন্য ইসলামিক বিধান অনুকরণ করা

রাতে ঘুমানোর পূর্বের সাধারণ দোয়াঃ


রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর আগে এই দোয়াটি পাঠ করতেন:
আরবি:

بِاسْمِكَ اللّٰهُمَّ أَمُوْتُ وَأَحْيَا

উচ্চারণ:
"বিসমিকাল্লাহুম্মা আমূতু ওয়া আহইয়া।"
অর্থ:
"হে আল্লাহ! আপনারই নামে আমি মৃত্যুবরণ করছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনারই নামে জীবিত হচ্ছি (জাগ্রত হচ্ছি)।"

  • অনিদ্রা বা অস্থিরতা দূর করার দোয়াঃ
যদি ঘুম না আসে বা রাতে অস্থিরতা বোধ হয়, তাহলে এই দোয়াটি পড়া যেতে পারে:
আরবি:

اللَّهُمَّ غَارَتِ النُّجُومُ وَهَدَأَتِ الْعُيُونُ وَأَنْتَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ الَّذِي لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ أَهْدِئْ لَيْلِي وَأَنِمْ عَيْنِي

উচ্চারণ:
"আল্লাহুম্মা গারাতিন নুজুমু, ওয়া হাদায়াতিল উইয়ুনু, ওয়া আন্তাল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু, আল্লাজি লা তা’খুযুহু সিনাতুন ওয়ালা নাউমুন। ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুমু, আহদি’ লাইলি ওয়া আনমি ‘আইনি।"
অর্থ:
"হে আল্লাহ! তারকারাজি ডুবে গেছে, চোখগুলো শান্ত হয়েছে (ঘুমিয়ে পড়েছে), আর আপনি তো সেই চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী সত্তা, যাকে তন্দ্রা বা ঘুম স্পর্শ করে না। হে চিরঞ্জীব, হে চিরস্থায়ী! আমার রাতকে শান্ত করুন এবং আমার চোখকে ঘুমিয়ে দিন।"

ঘুমানোর আগে অন্যান্য করণীয়ঃ


  • সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পাঠ করাঃঘুমানোর আগে দু’হাতের তালু একত্রিত করে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে যতদূর সম্ভব শরীরের উপর হাত বুলিয়ে নেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই আমলটি করতেন।
  • ঘুমানোর আগে তাসবীহ পাঠঃঘুমানোর আগে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করাও একটি ফজিলতপূর্ণ আমল, যা ক্লান্তি দূর করতে এবং ঘুম আনতে সাহায্য করে।
  • অযু করে ঘুমানো: ঘুমানোর আগে অযু করে বিছানায় যাওয়া সুন্নাহ।
  • বিছানা ঝেড়ে নেওয়া: বিছানায় যাওয়ার আগে বিছানা ঝেড়ে নেওয়া মুস্তাহাব।
  • ডান কাত হয়ে শোয়া: ডান কাত হয়ে শোয়া সুন্নাহ।এই দোয়াগুলো এবং আমলগুলো নিয়মিত পালন করলে ইনশাআল্লাহ ভালো ঘুম আসবে এবং মনে প্রশান্তি লাভ হবে।

শেষকথাঃ


        পর্যাপ্ত ঘুম একটি সুস্থ জীবনের জন্য অপরিহার্য। যদি আপনার দীর্ঘসময় ধরে ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে। যদি ওপরের টিপসগুলো অনুসরণ করার পরও আপনার ঘুমের সমস্যা করে, এবং এটি আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করতে শুরু করে, তাহলে  একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা জরুরি। একজন চিকিৎসক বা ঘুম বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন। অনিদ্রা বিভিন্ন শারীরিক বা মানসিক রোগের লক্ষণও হতে পারে, যা নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

রায়আন আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url